Header Ads

Header ADS

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শিশুকাল


হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শিশুকাল


সাধারণত বাচ্চাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে প্রথম ছয় বছরে। এ সময়টাতে তাদের যথেষ্ট ভালােবাসা আর মনােযােগ প্রয়ােজন। কোয়ালিটি টাইম বা মানসম্পন্ন সময় বলে আমরা একটা বিষয় জানি। আমাদের ব্যস্ত জীবন আর ক্রমাগত সব মনােযােগ বিঘ্ন করা বিষয়ের মাঝে শিশুদেরকে আরও বেশি সময় দিতে হবে। যত্ন নিতে হবে। বিধবা মা আমিনার আলিঙ্গন, চুমু আর মায়াভরা হাসির মধ্য দিয়ে শিশু মুহাম্মাদ -এর আবেগী প্রয়ােজনগুলাে পূরণ হয়েছে। শিশুদের জন্য এমন আনন্দ-উত্তেজনাময় পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা জীবনের জরুরি দক্ষতা অর্জন করতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ক্ষেত্রে সেটা ছিল মরুপ্রান্তর । আমাদের জন্য তা হতে পারে স্কুল, দিবা সেবাকেন্দ্র, রিডিং ক্লাব, আত্মীয়স্বজনের বাসা বা শিশুকেন্দ্রিক ফিটনেস সেন্টার।

মানসিক বিকাশ ছয় বছর বয়স পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর মায়ের সঙ্গে ছিলেন। মা মারা যাওয়ার পর প্রথমে দাদা আবদুল মুত্তালিব এবং পরে চাচা আবু তালিবের সাথে থাকেন। একটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য যে ধরনের আদর, ভালােবাসা ও যত্ন দরকার ছিল, তার সবই তিনি তাঁদের কাছে পেয়েছিলেন।

অন্যদিকে, মরুভূমির কঠিন পরিবেশ তাঁকে দিয়েছে জীবনমুখী নাম দক্ষতা অর্জনের উৎসাহ। শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে প্রথম ছয় বছরে। প্রথম বছরে শিশুর মধ্যে অনুভতি জন্মলাভ করে। দ্বিতীয় বছর থেকে তার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকে। তৃতীয় বছরে বাচ্চারা অন্যের সাথে ভাববিনিময় করতে শেখে। চতুর্থ বছর থেকে ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে আত্মনির্ভরশীল। পঞ্চম আর ষষ্ঠ বছরে তারা নিজেদের চাওয়া-পাওয়াগুলাে তুলে ধরতে শেখে। এ সময় নিজেদের আবেগ-অনুভূতিগুলাে আরও ভালােভাবে প্রকাশ করতে শেখে। শিশুদের এই ছয় বছরের ব্যাপারগুলাে একটি চার্টে আমরা দেখব।

এই অধ্যায়ে আমরা ছয় বছর বয়স পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ  (সাঃ) -এর বাল্যকালকে দেখব। তাঁকে বড় করতে যেয়ে তার মা ও দুধ-মা কী বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন, তা দেখব। এরপর দেখব, তাঁর শিশুকালের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা কীভাবে শিশুদের বড় করতে পারি।

ছয় বছরের নিচে বাচ্চারা
পরিবেশ আর ব্যক্তিত্ব ভেদে শিশুদের বেড়ে ওঠার গতি কমবেশি হয়ে থাকে। সে হিসেবে বলতে গেলে রাসূলুল্লাহ  তার বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বড় ছিলেন। তাঁর বয়স যখন দুবছরের নিচে, তখন তার এনার্জি দেখে অনেকেই অবাক হতেন। তারপরও শিশুদের মাঝে এমন কিছু ব্যাপার থাকে যা মােটামুটি সবার জন্য এক। ছয় বছর পর্যন্ত একজন শিশুর বেড়ে
ওঠার ব্যপারগুলেো আমরা আর একটা চার্টে দেখব।


শিশুরা সাধারণত প্রথম পর্যায়গুলাে মায়ের সাথে বেশি কাটায়। অনুভূতি সংক্রান্ত চাহিদাগুলাে তিনিই পূরণ করেন। আর পরবর্তী পর্যায়গুলাে সামাজিক আর ভাষাগত দক্ষতা অর্জনে কেটে যায়। আমরা দেখি যে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর জীবনেও এমনটা হয়েছে। অন্য আর দশটা শিশুর মতাে তার ঐ সময়টাও কেটেছে একান্তে মায়ের সাথে।

ভালােবাসার চাহিদা পূরণ বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের আর্থিক দায়দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন দাদা আবদুল মুত্তালিব। সংসার খরচের চিন্তা না-থাকায় মা আমিনা তার পুরাে সময়টা ছেলের পেছনে দিতে পেরেছিলেন। মা হিসেবে বাবা না থাকার কষ্ট কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিতে পেরেছিলেন। কখনাে আদরঘন আলিঙ্গন, কখনাে মমতামাখা চুমু, কখনাে-বা শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দিকে তাকিয়ে ভালােবাসার হাসি, এভাবেই তাকে আগলে রেখেছিলেন মা আমিনা। শিশুকালে রাসূল (সাঃ)তার মায়ের সঙ্গে খুব বেশি একটা সময় কাটাতে পারেননি। অনেক শিশুরা এ বয়সে মায়ের সাথে অনেক সময় কাটায়।

কিন্তু তারপরও শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) যে ভালােবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন, সেটা আজকাল অনেক শিশুর ভাগ্যেই জোটে না। 
আজকালকার মায়েরা অনেক বেশি ব্যস্ত। অনেক দায়িত্ব; ঘর সামলানাে, চাকরি, স্বামীসেবা, অন্যান্য বাচ্চাদের দেখভাল ইত্যাদি। মা আমিনার কাধে এত বােঝা ছিল না। সংসার খরচের দায়ভার নিয়েছিলেন দাদা। কুঁড়ি বছর বয়সেই বিধবা আমিনাকে এসব নিয়ে কোনাে দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। আমিনার সব ব্যস্ততা ছিল একমাত্র সন্তান মুহাম্মাদকে ঘিরে।

তখনকার সমাজে সন্তানের বেড়ে ওঠায় বাবারাই মূল ভূমিকা পালন করতেন। কিন্তু পরিস্থিতির দাবি মেনে মা আমিনা তার মাতৃসুলভ ভালােবাসা আর আদরের পুরােটাই একমাত্র সন্তান মুহাম্মাদ -এর ওপর ঢেলে দিয়েছিলেন।

সন্তানের ওপর ভালােবাসার প্রভাব 
শিশুর মানসিক বিকাশে ভালােবাসা আর আদরের প্রভাব অনেক। এতে তার নিজের ব্যাপারে আস্থা জাগে, আত্মবিশ্বাস জন্মে। আবেগ-অনুভূতি গড়ে ওঠে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, এতে করে শিশুরা নিজেদের নিরাপদ মনে করে। পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা বাড়ে। আপনিও আপনার বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরুন। ঘুম থেকে ওঠার পর কিংবা বাইরে থেকে বাসায় এসে তাকে সালাম দিন। চুমু দিন। তার সাথে খেলুন। এগুলাে ওর মানসিক স্বাস্থ্য ভালাে রাখবে। আত্মমর্যাদা বাড়াবে।

আপনার অবস্থা হয়তাে এমন না যে, আপনি পারফেক্ট বাবা-মা হবেন। কিন্তু যতটুকু পারুন ওকে সময় দিন, আদর করুন। মনােযােগ দিন। মাঝেমধ্যে বা কেবল বিশেষ কোনাে ঘটনায় ওর প্রতি আদর না-দেখিয়ে নিয়মিত দেখান।

কীভাবে শিশুর মানসিক চাহিদা পূরণ করবেন
• প্রতিদিন চুমু দিন, জড়িয়ে ধরুন।
 • ওর কথা মন দিয়ে শুনুন। বাধা দেবেন না। 
• বাসার বাইরে থাকলে ফোন দিয়ে কথা বলুন।
 • ওর সাথে খেলুন।
 •নিজের পোশাক ময়লা হওয়া নিয়ে চিন্তার দরকার নেই। 
• ভালোবাসা দিয়ে দিন শুরু করুন। আর অখুশিহয়ে কখনো দিন শেষ করবেন না।


সন্তানের জন্য বাঁচা
মা আমিনার স্বামী মারা যান ৫৭১ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র বিশ । তারপরও তিনি কিন্তু আর বিয়ে করেননি। তখনকার সমাজ অবশ্য বিধবাদের খাটো চোখে দেখত না। যাদের বংশ ভালাে ছিল, তাদেরকে উঁচু নজরে দেখত। আমিনার রূপ আর কবিতা আবৃত্তির গুণে চাইলেই তিনি আবার বিয়ের পিড়িতে বসতে পারতেন। সমাজ যে তাঁকে এ ব্যাপারে। পীড়াপীড়ি করেনি, তা কী করে বলি? কিন্তু তিনি বিধবাই থেকে গেলেন। সেই সমাজে বড় পরিবারের আলাদা মর্যাদা ছিল। আমিনার মনেও হয়তাে অমন বড় পরিবারের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তিনি হয়তাে তার ছেলে মুহাম্মাদের জন্য নিজেকে কোরবান করেছিলেন। শিশু মুহাম্মাদের জীবনকে ফুলে-ফলে সুশােভিত করতে নিজের জীবনের সাথে আপােষ করেছিলেন। তার এই সিদ্ধান্ত মােটেও স্বাভাবিক ছিল না। ছিল প্রথাবিরােধী। বিশ বছর বয়সী এক বিধবা তরুণীর জন্য এই সিদ্ধান্ত যে অনেক কষ্টের ছিল, তা বলাই বাহুল্য।

কীভাবে নিজের সন্তানকে অগ্রাধিকার দেবেন
শিক্ষাবিদরা শিশুদের জন্য আলাদা সময় রাখার গুরুত্বের কথা বলেন। যেন মনে হয়, শিশুদের সাথে সময় কাটানাে একটা বােঝা। আনন্দের কিছু না। চাকরিজীবী মায়েরা তাদের সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। এতে অনেক মা-ই মনে মনে এক ধরনের অপরাধবােধে ভােগেন। তাদের এই অপরাধবােধে প্রলেপ দেয়ার জন্য আলাদা সময় ধারণার জন্ম হয়। অথচ আলাদা সময়ের বদলে আমাদের তাে শিশুদের সাথে এমনিতেই সময় কাটানাের কথা। আর সেটাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ঘড়ি ধরে কেন? কত সুন্দরভাবে সময় কাটাচ্ছি বিবেচনার সাথে সাথে কতক্ষণ সময় কাটাচ্ছি, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ না। বাবা-মায়েরা সন্তানের সাথে যত বেশি সময় কাটাবে (এখানে ‘বেশি’ বলতে পরিমাণের কথা বলছি) তাদের সামাজিক, মানসিক ও একাডেমিক সমস্যা তত কম হবে। মাদকে জড়ানাের আশঙ্কা কমবে। বখাটেগিরি বা এ ধরনের কোনাে অপরাধমূলক কাজ অথবা বিয়ের আগে বিপরীত লিঙ্গের কারও সাথে হারাম সম্পর্কে জড়ানাের প্রবণতা কমবে। লরা রামিরেজের কথায় এমনটাই পাওয়া যায়।

বাচ্চাদের পার্কে নিয়ে যান। এটা ভালাে। কিন্তু এটা কোনােভাবেই ভালাে প্যারেন্টিং-এর বিকল্প নয়। বাবা-মা'কে তাদের বাচ্চার ছায়া হয়ে থাকতে হবে। এর মানে তাদের সাথে। ভালাে সময় কাটাতে হবে। ওদের সময়টা যখন ভালাে যাবে না, তখন ওদের পাশে থাকতে হবে। ওদের প্রতিটা সমস্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।

বাচ্চার সাথে সময় কাটানাের মানে কী 
• সময় কাটানাে মানে এই না যে, সব সময় কিছু না কিছু করতেই
হবে। ওদের সাথে থেকে ওরা কী করছে, না করছে তার ওপর নজর রাখাই যথেষ্ট। 

ওকে সময় দেয়া সংসারের দৈনন্দিন টুকিটাকি কাজের অংশ নয়। কাজেই ওকে এমনভাবে সময় দেবেন না, যাতে ওর মনে এইধারণা উঁকি দেয়। 

• যেকোনো সময় আপনার কাছে ঘেষতে ওর মনে যেন কোনাে
ধরনের সংকোচ কাজ না করে।
মরু শিক্ষা রাসূল 
ছালেবেলায় শুধু মায়ের কাছ থেকেই শেখেননি। তার দুধ-মা হালিমা এবং তার পরিবার থেকেও মানসিক বিকাশের শিক্ষা নিয়েছেন। হালিমার আরও তিন সন্তান ছিল- আবদুল্লাহ, আনিসা, শায়মা। সাথে ছিল তার স্বামী আল হারিস। মক্কা থেকে তাদের বাড়ির দূরত্ব ছিল ১৫০ কিলােমিটার। মাঝে মাঝেই এখান থেকে মক্কায় যাওয়া হতাে তার। প্রায় চার বছর তিনি এখানে কাটিয়েছেন। অনেক কিছু শিখেছেন এখান থেকে। 
সে সময়কার আরব উপদ্বীপের মরুভূমি অঞ্চল সম্পর্কে জানলে সহজে বুঝতে পারব রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাল্যকালে মরুভূমির ভূমিকা কেমন ছিল। কী কী মূল্যবােধ তিনি এখান থেকে শিখেছেন। 
তখন স্কুল-কলেজ বলতে তেমন কিছুই ছিল না। মরুভূমির এক একটা পরিবারই ছিল এক ধরনের স্কুল। শহরের মা-বাবারা বাচ্চাদের চারিত্রিক বিকাশের জন্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যই মরুর এসব পরিবারে পাঠাতেন।

মূলত, গ্রামাঞ্চল ও মরুভূমির চেয়ে শহর অঞ্চলে অসুখ-বিসুখের মাত্রা ছিল তুলনামূলক বেশি। শহরের জনসংখ্যা ছিল প্রায় বিশ হাজার। ইসলামের বার্তা পুনরায় চালু হওয়ার আগে থেকেই সেখানে হজের রীতি বহাল ছিল। হজ্বের সময়ে স্বাভাবিক কারণে লােকজনের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেত। যার কারণে নানা রকম রােগ বালাই এর আশঙ্কাও বৃদ্ধি পেত। এসব কারণে রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা বাড়ানাের জন্য সেসময় অধিকাংশ শহুরে পরিবারের বাচ্চাদের মরু অঞ্চলে পাঠানাে হতাে। তাছাড়াও মরু অঞ্চলের কথ্য আরবি যেকোনাে ধরনের বিকৃতি থেকে মুক্ত ছিল। মরুভূমির বেশিরভাগ নারীই পেশা হিসেবে বা পারিবারিক বন্ধন গড়ার খাতিরে শহরের বাচ্চাদের লালন-পালনের জন্য নিয়ে যেতাে। নতুন আর অজানাকে জানার, আবিষ্কারের পসরায় সজ্জিত ছিল মরুভূমির উন্মুক্ত বালুচর। শহরের দালানঘরে সেই সুযােগ কোথায়?

মরুভূমিতে থেকে থেকে শিশু মুহাম্মাদের সামাজিক আর যােগাযােগের দক্ষতা বেড়েছে। শারীরিক সামর্থ্য বেড়েছে। ভাষা শাণিত হয়েছে। সে সময়ের মরুঅঞ্চল, বাচ্চাদের এসব দিকগুলাে বিকাশের জন্য দারুণ সহায়ক ছিল।

তবে আজকের জমানায় এসে আমি আপনার শিশুকে মরুভূমিতে পাঠাতে বলব। কিন্তু যেসব পরিবেশ শিশুদেরকে উদ্দীপ্ত করবে, সেগুলােকে কখনােই উপেক্ষা করবেন না। এগুলাে হতে পারে স্কুল, দিবাসেবা, আত্মীয়ের বাসা কিংবা এ ধরনের অন্য কিছু। খেয়াল রাখতে হবে, এই জায়গাগুলাে যেন। নিরাপদ হয় এবং শিশুর প্রতিভা বিকাশ ও আবিষ্কারে সহায়ক হয়।
মরুজীবন
মরুজীবনের বাস্তবতা বুঝার দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে। যথা:-
• মুহাম্মাদ -এর জীবনে মরু জীবন কী ধরনের প্রভাব ফেলেছিল।
• তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে আমরা কী শিখতে পারি।

মরুবাসীদের জীবন ছিল যেনতেন উপায়ে বেঁচে থাকা। টিকে থাকাটাই মূখ্য। বিলাসিতার কোনাে জায়গা নেই সেখানে। শুষ্ক এই আবহাওয়ার তীব্র দাবদাহে সূর্যের নিচে ডিম ভাজি হয়ে যেত। পানি আর ছায়া দুটোরই অভাব ছিল। আজকাল আমরা পিপাসা মেটানাের জন্য যে পরিমাণ পানি খাই, তখন তারা এত খাওয়ার সুযােগ পেত না। সামান্য পানি খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য শুধু গলা ভেজাতেন। যেহেতু পানি কম ছিল, খাবারের উৎসও কম ছিল। মরুদ্যান, কুয়াে বা ঝরনার আশপাশ ছাড়া ফসলের ক্ষেত খুব একটা হতাে না।

খাওয়ার কষ্ট, পানির কষ্ট নিয়েই বেদুইনরা বাঁচতে শিখেছে। আরও খাবাে, আরও খাবাে! এ রকমটা বলে অভিযােগ করতেন না। খাওয়া-দাওয়া। বা ভােগ করা তখন আনন্দের জন্য ছিল না। ছিল টিকে থাকার জন্য। জীবনের এই কঠিনতা তাদেরকে জীবনের দুঃখ কষ্ট গুলােকে বিনা অভিযােগে বরণ করতে শিখিয়েছিল।

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এ ধরনের পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর ওপর এই পরিবেশের যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তিনি কখনাে পেট পুরে খাননি। ক্ষুধার যন্ত্রণা দমন করার জন্য পেটে চ্যাপ্টা পাথর বাঁধতেন। এমন কত দিন গেছে তার ঘরে চুলাে জ্বলেনি। খুব কম সময়েই তিনি মাংস খেয়েছেন; বরং বেশিরভাগ সময়েই খসখসে রুটি খেতে হয়েছে। খাবার না থাকলে সিয়াম পালন করতেন। তালগাছের পাতা দিয়ে বানানাে মাদুরে ঘুমােতেন।

বর্তমান দুনিয়ার চোখে দেখলে তার জীবনযাপন পদ্ধতি অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে তিনি বাচ্চা বয়সেই এমনটা শিখেছেন। সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে ধরে রেখেছেন। এমনকি মক্কায় আসার পরও। মরুভূমিতে তিনি যেসব দামি মূল্যবােধ অর্জন করেছিলেন, তার নিজ পরিবেশ সেগুলােকে আরও জোরদার করেছে।

মরুভূমি থেকে নিয়ে আসা মূল্যবােধ
রাসূল  (সাঃ)মরুজীবন থেকে যে শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন, তাঁর মা সেটার মূল্য বুঝেছিলেন। স্কুলে যদি ভালাে কিছু শেখায়, তাহলে বাবা-মায়েদের বিরােধী কিছু শেখানাে ঠিক হবে না। শিশুকে বরং এমন পরিবেশ দিতে হবে, যেটা তার স্কুলের শিক্ষাকে আরও পােক্ত করবে। মরুস্কুলে রাসূল  (সাঃ)ও সহ্য করার ক্ষমতা আর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের যে শিক্ষা নিয়েছিলেন, মা আমিনা তার ঘরে সেই একই শিক্ষা জারি রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)ও মরু শিক্ষার বাস্তবতা পরিবারে এসেও পেয়েছিলেন। পারিবারিকভাবেই তার জীবন ছিল সাদাসিধা, অনাড়ম্বর। তাঁর মা শুকনাে মাংস খেতেন। দাদা দানের টাকা জোগাড় করে হজ্ব পালনকারীদের পানির ব্যবস্থা করতেন। চাচা যৌথ পরিবারের খরচ জোগাতেন। ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ পরিবারেই পেয়েছিলেন।

বাচ্চাকাচ্চারা স্কুলে যা শেখে, ঘরে এবং সাধারণভাবে সমাজে যদি সেই একই শিক্ষা জোরদার করে, তাহলে বাচ্চারা নিজেদের নিরাপদভাবে এবং আত্মবিশ্বাসী হয়।


আত্মশৃঙ্খলার মূল্য

শৃঙ্খলার মাধ্যমে শিশুরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। তাদের আচারআচরণ সন্তোষজনক হয়। ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শেখে। তবে এজন্য বাবামায়ের তরফ থেকে এনার্জি ও কমিটমেন্টের দরকার হয়। বাবা-মা কতটা শক্তি ঢালবেন আর কতটা লেগে থাকবে তা নির্ভর করে বাচ্চার ব্যক্তিত্ব এবং কী রকম পরিবেশে সে বেড়ে উঠছে তার ওপর।


রাসূল (সাঃ) মরুভূমিতে শৃঙ্খলার পাঠ নিয়েছেন। নির্দিষ্ট সময়ে তাঁকে ঘুমােতে যেতে হয়েছে। উঠতে হয়েছে। বিভিন্ন কাজেকর্মে সহযােগিতা করতে হয়েছে। গবাদিপশুর দেখভাল করতে হয়েছে। একটু অন্যরকমভাবে মক্কায় নিজের বাড়িতে সেই একই শৃঙ্খলা জোরদার করা হয়েছে। বাচ্চার চারপাশ আর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে খাপ খায় এমন শৃঙ্খলার মধ্যে বাচ্চাকে বেড়ে তােলা আজকের দিনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ । মন যা-ই চাক, বাচ্চাকে দায়িত্ববানের মতাে কাজ করতে হবে এটাই শৃঙ্খলা। কচি বয়সেই এটা গড়ে তুলতে হবে।


ষাটের দশকের শেষের দিকে বাচ্চাদের শৃঙ্খলা নিয়ে এক বিখ্যাত গবেষণা হয়। সেখান থেকে দেখা যায়, বাচ্চা বয়সে শেখা শৃঙ্খলা পরবর্তী বয়সে টেকসই হয়। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ওয়াল্টার মিসচেল চার বছর বয়সী একদল বাচ্চাকে একটা করে মার্শম্যালাে দেন। তাদেরকে দুটো অপশন দেন; হয় এখন খাও। নয় পরে খাও। তবে পরে খেলে আরেকটা মার্শম্যালাে পাবে। তাে এই গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশুরা তাদের খাওয়ার লােভ সংবরণ করতে পেরেছিল, পরিণত বয়সে তাদের মধ্যে শৃঙ্খলার ছাপ বেশি পাওয়া গিয়েছিল। জীবনে তাদের অর্জনও বেশি।

বাচ্চাকাচ্চাদের শৃঙ্খলা শেখাবেন কীভাবে

মারধর, গালি-বকা দিয়ে শৃঙ্খলা শেখানাে যায় না। সদয় আচরণ আর সুন্দর লালন-পালনের মাধ্যমে এটা সম্ভব। নিচে আমরা কিছু উপায় দিচ্ছি। চেষ্টা করে দেখুন

• ভালাে কাজের প্রশংসা করুন। এটা তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস
বাড়াবে। আর আপনাকে খুশি করার জন্য এমন কাজ বার বার
করতে চাইবে।
• এমনভাবে বলুন যেন সে বুঝে।
• করাে না' কথাটা অতিরিক্ত ব্যবহার করবেন না। গলার আওয়াজ
উঁচু করাে না'। এমনটা না বলে বলুন, একটু আস্তে কথা বলাে'।
• বকাঝকার মধ্যে না রেখে মজাদার বিকল্পের ব্যবস্থা করুন।
• ওদের সাথে কোনাে কিছু নিয়ে আলাপ করতে গেলে এমন সময়
করবেন না, যখন আপনি রেগে আছেন। ওর মন খারাপের সময়ও আলাপ করবেন না।

সামাজিক দক্ষতা শেখা

মরুভূমিতে থাকা অবস্থায় শিশু মুহাম্মাদ বেশকিছু কাজ করতেন বলে ধারণা করতে পারি। এই যেমন- পানি আনা-নেয়া , গবাদিপশুর দেখভাল, তাঁবু টাঙানাে, খুলে ফেলা, বড়দের ও মেহমানদের সাহায্য করা। এগুলাে তাঁর মধ্যে সহযােগিতা, ভাগাভাগি আর অন্যের দেখভালের মতাে গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাসগুলাে গড়ে দিয়েছে।


শারীরিক সক্রিয়তার সাথে দক্ষ হওয়ার সরাসরি সম্পর্ক আছে। যেসব শিশুরা শারীরিকভাবে বেশি সক্রিয়, তারা কম সক্রিয় শিশুদের তুলনায় সামাজিক দায়িত্ব ও নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালনে বেশি অগ্রণী হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে শিশুকে এজন্য যেন চাপাচাপি করা না-হয়। আর সক্রিয় হওয়ার জন্য ওর পরিবেশ নিরাপদ ও আরামদায়ক রাখতে হবে।


মরুভূমিতে দৌড়াদৌড়ি ও খেলাধুলা করার জন্য শিশু মুহাম্মাদ -এর সামনে ছিল প্রশস্ত মরুপ্রান্তর। শিশুসুলভ বিভিন্ন কাজকর্মের মধ্য দিয়েই তিনি একে অন্যকে সহযােগিতা করতে শিখেছেন। অন্যের সাথে ভাগাভাগি ও দেখভাল করতে শিখেছেন।


ভবা যখন খুশিতে থাকে, আনন্দে থাকে, তখন তারা ভালাে শেখে। মজাদার সময়গুলাে শিশুদের বেড়ে ওঠার সেরা সময়। কারণ, তারা খেলতে পচন্দ করে। চমক পছন্দ করে। কোনাে কোনাে বাবা-মা মনে করেন শিশুদের খেলাধুলা মানে সময় নষ্ট । এমন ধারণা মােটেই ঠিক না।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ওরা যখন খেলার মধ্যে থাকে, তখনই ওরা সহজে শেখে। গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা অর্জন করে।
গাধা স্কুলগুলােতে কচি শিশুদের আদেশ-নিষেধের বেড়াজালে বন্দি করে ফেলা হয়। খালি পড়াে আর পড়াে। অন্যদিকে, উন্নতমানের স্কুলগুলােতে বিভিন্ন দক্ষতা আর আচরণ শেখানাের জন্য মজাদার কাজকারবার করা হয়।
খেলাধুলার গুরুত্ব
ছােট বয়সে তাদের খেলার সময়সীমা কেটে দিবেন না। এমন ভাবার দরকার নেই যে, তারা বড় হয়ে গেছে, এখন আর বেশি খেলার দরকার নাই। আবার সে কোন ধরনের খেলা খেলবে, সেটাও চাপিয়ে দিতে যাবেন । শরীয়াহ সমর্থিত যেকোনাে খেলা ওকে খেলতে দিতে পারেন।
শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলছিলেন, তখন বক্ষবিদারণের সেই বিখ্যাত অলৌকিক ঘটনা ঘটে। কাজেই খেলাধুলার সময়কে অবমূল্যায়ন করবেন না। শিশুদের বেড়ে ওঠা ও শেখার জন্য এটা পার্ফেক্ট অপরচুনিটি।

মরুভূমিতে থাকার সময়ে তিনি দায়িত্ব ও যােগাযােগ রক্ষার ব্যাপারগুলাে শিখেছেন। ওখানকার আবহাওয়া অনেক গরম। জীবন ধারণও কঠিন। কিন্তু মক্কার ব্যস্ত গলির চেয়ে মরুরাস্তায় তিনি ছুটে বেড়াতে পেরেছেন। যাযাবরদের জীবন মানে প্রতিদিন নতুন গন্তব্য। তাঁবু গাড়া, গবাদিপশু দেখা, আশপাশ দিয়ে যাওয়া কাফেলাগুলােকে সাময়িক আশ্রয় দেয়া আর নিরাপদ জায়গা খোঁজা।

নিঃসন্দেহে শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)এর জন্য এ ধরনের পরিবেশ ছিল বেশ রােমাঞ্চকর। উত্তেজনাময়। এটা তার চরিত্র বিকাশের সুযােগ করে দিয়েছে। আমি আগেই বলেছি, আনন্দের মাঝে শিশুরা শেখে ।


ভাষা দক্ষতা

মরুভূমির পরিবেশ তার ভাষা দক্ষতা বাড়াতেও সাহায্য করেছে। স্কুলে ভর্তির আগের সময়টাতে শিশুদের মধ্যে এই দক্ষতা গড়ে ওঠে। মরুভূমির পরিবেশ বিজাতীয় সংস্কৃতি আর ভাষা বিকৃতি থেকে মুক্ত ছিল। যে কারণে রাসূল (সাঃ) হয়ে উঠেছিলেন বিশুদ্ধভাষী। অনেক শব্দ শিখেছেন সেখানে।


মক্কায় তাঁর পরিবারের চেয়ে এখানে সদস্য সংখ্যা পাঁচজন বেশি ছিল। তাছাড়া ওখানে কেবল হজের মৌসুমে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লােকজন আসত। এখানে প্রায়ই বিভিন্ন কাফেলা যেত। তাদের সংস্পর্শে তিনি বিভিন্ন আঞ্চলিক আরবির সান্নিধ্যে আসেন।


মক্কার লােকেরা তাদের শিশুদের যেসব কারণে মরুভূমিতে পাঠাত, তার মধ্যে একটি ছিল তাদের আরবির ভিত যাতে মজবুত হয়। কমবেশি চার বছর শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) সেখানে কাটিয়েছেন। আমাদের সময়ে হিসেব করলে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে যে সময়টা বাচ্চাকাচ্চারা বাবা-মায়ের সাথে থেকে অনেক কিছু শেখার সাথে ভাষাটাও শেখে। তাে ঐ বয়সে মরুভূমির অনুকূল পরিবেশ ভাষায় তার শক্ত ভিত গড়ে দিয়েছিল।


অন্যান্য বিষয়ে পারদর্শিতার আগে বাচ্চাদের মধ্যে ভাষাপটুতা আগে তৈরি হয়। অনেক শিশু প্রথম বছরে বিভিন্ন শব্দ শেখে। দুই বছর থেকে চার বছরে শব্দভাণ্ডার সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে। চার বছরের মধ্যে গড়পড়তা একটি শিশু হাজার খানেক শব্দ শেখে। এসব শব্দ ব্যবহার করেই। তারা তাদের চাহিদা তুলে ধরে। কথা বলে আত্মবিশ্বাস পায়।


আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, যেসব শিশুরা ঠিকমতাে কথা বলতে পারে না, তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করে। এতে করে তাদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু আচরণ চোখে পড়ে। যেমন : উগ্র মেজাজ, অযথা চিৎকার-চেঁচামেচি।


শিশুর ভাষাদক্ষতা কীভাবে বাড়াবেন পনের মিনিট করে ওকে গল্প পড়ে শােনান। বর্ণনামূলক গল্প শিশুর কল্পনাশক্তি ও শব্দভাণ্ডার বাড়ায়।
• ওর কথা মন দিয়ে শুনুন। এতে করে ওর কথা বলার নৈপুণ্য বাড়বে। ওর মধ্যেও মন দিয়ে কথা শােনার অভ্যাস গড়ে তুলুন। ভাষাদক্ষতা বাড়ানাের জন্য অন্যের কথা মন দিয়ে শােনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বড়দের জন্যও এটা খুব কাজের।
মায়ের মৃত্যু
এ পর্বে আমরা কথা বলব রাসূল (সাঃ) এর মায়ের মৃত্যু নিয়ে। এরপর সেখান থেকে তার দাদার বাড়িতে লালন-পালন। সেখানে কিন্তু তিনি চমক্কার আদরযত্নে লালিত-পালিত হয়েছেন। প্রতিটি শিশুর শৈশব এমনই হওয়া উচিত আসলে।

মক্কায় ফিরে শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) দুবছর মায়ের সঙ্গে কাটান। মা আমিনা মারা যান ২৬ বছর বয়সে। তখন মুহাম্মাদ -এর বয়স মাত্র ছয় । এত অল্প বয়সে যাদের মা মারা গেছেন, কেবল তারাই হয়তাে তার কষ্টটা বুঝতে পারবেন।

রােমান অর্থডক্স যাজক এবং ঔপন্যাসিক কন্সট্যান্টিন ঘিরঘিউ (Constantin Gheorghiu) তার বিখ্যাত ‘লা ভিয়ে ডে মাহােমেত (La Vie De Mahomet) বইতে সেই করুণ দৃশ্যের কল্পনা করেছেন এভাবে

‘শিশু তার মায়ের কবরের পাশে বসে আর্তনাদ করছে, ‘মা, তুমি বাসায় আসাে না কেন? এই জীবনে তুমি ছাড়া আমারআর কে আছে??

এই বর্ণনা ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরযােগ্য না। তবে এমন করুণ অবস্থার মুখােমুখি যারা হননি, তারা হয়তাে এ থেকে তার কষ্টের কিছুটা আঁচ করতে পারবেন। বাবাকে তাে তিনি কখনাে দেখেনইনি। জন্মের আগেই তার বাবা মারা গিয়েছিলেন। তিনি মায়ের খুব আপন ছিলেন। তার সাথে জড়িয়ে আছে কত না-ভােলা স্মৃতি।

বাস্তবে বলুন তাে কে চায় এমন পরিস্থিতির মুখােমুখি হতে? কেউ না। তবে শিশুর কাছের কেউ, আপন কেউ যদি মারা যায়, বা তার সাথে বিচ্ছেদ হয়, সেক্ষেত্রে এ ধরনের পরিস্থিতি মােকাবেলার উপায় জানা জরুরি।

কীভাবে মােকাবেলা করবেন।
• প্রথম দফাতেই তাকে মৃত্যুর খবরটা জানিয়ে দিন। কারণ, ঘরের পরিবেশ দেখে এমনিতেই সে বিষয়টা আঁচ করবে। আর তাছাড়া তার জানার অধিকার তাে আছেই।

বলার সময় বাচ্চার বয়সটাও মাথায় রাখবেন। ২ থেকে ৫ বছরের শিশুরা মৃত্যুকে ঘুমের মতাে মনে করে। তারা মনে করে মৃত মানুষ ঘুম থেকে আবার উঠবে। ৬ থেকে ৯ বছর বয়সী বাচ্চারা মৃত্যুর বিষয়টা বুঝবে। তবে আলাদা হয়ে যাওয়াটাকে তারা ভয় পায়।

• বাচ্চা যেন তার আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে সেজন্য তাকে উৎসাহ দিন। তার প্রশ্নগুলাের ঠিকঠাক উত্তর দিন।

• তার মধ্যে যেন ভালােবাসা হারানাের ভয় না-ঢােকে। আর যা। হয়েছে তার জন্য যে, সে কোনােভাবেই দায়ী না- এ ব্যাপারে তাকে আশ্বস্ত করুন। কারণ অনেক শিশুকে দেখা যায়, আপন কারও মৃত্যুতে সে নিজে নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করে। এমনও মনে করে যে, সে-ই এজন্য দায়ী।
মা হারানাের পর
মায়ের মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মুত্তালিব তার নাতির দায়িত্ব নেন। আবদুল মুত্তালিব কেমন মানুষ ছিলেন সে নিয়ে পরে এক অধ্যায়ে কথা বলব। এখানে আমরা নজর দেব নবির শৈশবে তাঁর দাদুর পরিবারের ওপর।

আচ্ছা কেউ কি বলতে পারেন রাসূল -এর দাদির নাম কী? আমাদের সীরাহ বইগুলােতে দাদার ভূমিকা অনেক বেশি করে বলা থাকে । আসলে ঐ পরিবারের সব আয় উপার্জন তিনিই করতেন। তাে সঙ্গত কারণেই তার কথা বেশি এসেছে। রাসূলেরও কিন্তু একজন দাদি ছিল। তার নাম ফাতিমা আমর ।
বালক মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে ঐটুকু বয়সে মমতা দিয়ে তিনিই আগলে রেখেছিলেন। কেন রাখবেন না? তিনি তাে শুধু আবদুল মুত্তালিবের স্ত্রী ছিলেন না। তিনি ছিলেন মা আমিনার শাশুড়ি। রাসূল -এর বাবা আবদুল্লাহ তাে তারই আদরের ছেলে ছিলেন।

ছয় বছর পর্যন্ত শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ছায়া হয়ে ছিলেন তাঁর মা আমিনা। মায়ের মৃত্যুর পর সে অভাব পূরণ করেন দাদি ফাতিমা। রাসূলের ছােট মেয়ের নাম তাে সবাই কমবেশি জানি, ফাতিমা। রাসূল (সাঃ); কি তাঁর দাদির সম্মানে মেয়ের নাম ফাতিমা রেখেছিলেন? এটা হলফ করে বলা যায় না। তবে সেই সম্ভাবনা উড়িয়েও দেয়া যায় না।
অপূর্ব বালক
বালক হিসেবে রাসূল (সাঃ)ছিলেন অসাধারণ। হাদিস থেকে দেখা যায়, তার দাদা ছােটবেলাতেই এটা খেয়াল করেছিলেন। বলেছিলেন এই ছেলে বড় হয়ে বিশেষ কিছু হবে। প্রায় একই রকমের ভবিষ্যদ্বাণী আরও একজন করেছিলেন। ১২ বছর বয়সে কিশাের মুহাম্মাদ (সাঃ)যখন সিরিয়া সফরে যান, তখন এক সন্ন্যাসী এ রকমটা বলেছিলেন।
বালক মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন দাদার ঘরে লালিত হচ্ছেন, তখন দাদার বয়স আশির কোঠায়। খুব ভালােবাসতেন নাতিকে। তবে এই নাতি যে এক সময় নবি হবেন এমন কথা তারা হয়তাে কল্পনাতেও কোনােদিন ভাবেননি। তাঁর মাও কি কখনাে এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন? বড় হয়ে বিশেষ কিছু হবেন এ পর্যন্তই হয়তাে।

তাঁকে নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাস তার কানেও পৌছাত। বার বার পৌছাত। তাঁকে নিয়ে তাদের ভাবনা তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন। যে বাচ্চা সব সময় বাবা- মায়ের মুখে শােনে সে ভদ্র, স্মার্ট, বড় হয়ে ভালাে কিছু হবে- সেই বাচ্চাকে দেখবেন; আর যে-বাচ্চা প্রতিনিয়ত বাবা-মায়ের গালি আর বকা খায়, সে বাচ্চাকে দেখবেন। দুই বাচ্চার বেড়ে ওঠাতে বিস্তর পার্থক্য খুঁজে পাবেন।

বাবা-মায়ের কাছ থেকেই কিন্তু শিশুরা নিজেদের ব্যাপারে জানতে শেখে। কারণ বাবা-মা তাকে সবচেয়ে ভালােভাবে চেনে। কাজেই তাদের কথা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। সেখান থেকেই তার মধ্যে আত্মমর্যাদা গড়ে উঠে। তারা যা বলেন, সেগুলাের অনুরণন তার কানে বাজতে থাকে। কাজেই শিশুদের নিয়ে যা-ই বলবেন, ভেবেচিন্তে বলবেন!

বাচ্চাদের আত্মবিশ্বাস কীভাবে বাড়াবেন প্রতিটা শিশুর মধ্যেই প্রতিভা আছে। আপনার নিজের বাচ্চাটাও প্রতিভাবান। আপনি তার প্রতিভা আবিষ্কারে সাহায্য করুন। তার প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করুন। সে যদি দেখে আপনি তার পাশে আছেন, তাকে সাহস যােগাচ্ছেন, তাহলে সে-ও নিজের সামর্থ্য নিয়ে বিশ্বাস করতে শিখবে।
বলার সময় কী কী শব্দ ব্যবহার করছেন, তা নিয়ে সতর্ক থাকবেন। বিশেষ করে ও কী করবে না-করবে এ জিনিসগুলাে বুঝিয়ে বলার সময় বেশি সতর্ক থাকবেন। আগে এক জায়গায় আমরা বলেছিলাম এটা করাে না'- এই কথাটা মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করবেন না। গঠনমূলক বা ইতিবাচকভাবে ওদের ভুলগুলাে ধরিয়ে দিন। আপনি কী চাচ্ছেন সেটা বলুন। যেমন- চিৎকার করাে না তাে'। এভাবে না-বলে বলুন, আস্তে কথা বলাে বাবা'।
বাচ্চার নেতিবাচক অভ্যাস বদলানাের জন্য আঘাত না-করে সহায়ক উপায় অবলম্বনের চেষ্টা করুন। যেমন- ‘এত আলসেমি করাে না' এভাবে না-বলে সে যেন মজাদার বা প্রােডাক্টিভ উপায়ে সময় কাটাতে পারে সে উপায় তালাশ করুন।
আট বছর বয়স পর্যন্ত বালক মুহাম্মাদ ও তাঁর দাদার সাথে ছিলেন। এরপর চলে যান তাঁর চাচার বাড়িতে। বিয়ে করার আগ পর্যন্ত ওখানেই ছিলেন। নবি মুহাম্মাদ $$-এর শৈশব-জীবনের শিক্ষাকে আমাদের বর্তমান জীবনে কীভাবে কাজে লাগিয়ে শিশু সন্তান প্রতিপালনে স্মার্ট হতে পারি, তার সংক্ষিপ্তসার তুলে এই অধ্যায় শেষ করছি।

No comments

Powered by Blogger.