হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শিশুকাল
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শিশুকাল |
সাধারণত বাচ্চাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে প্রথম ছয় বছরে। এ সময়টাতে তাদের যথেষ্ট ভালােবাসা আর মনােযােগ প্রয়ােজন। কোয়ালিটি টাইম বা মানসম্পন্ন সময় বলে আমরা একটা বিষয় জানি। আমাদের ব্যস্ত জীবন আর ক্রমাগত সব মনােযােগ বিঘ্ন করা বিষয়ের মাঝে শিশুদেরকে আরও বেশি সময় দিতে হবে। যত্ন নিতে হবে। বিধবা মা আমিনার আলিঙ্গন, চুমু আর মায়াভরা হাসির মধ্য দিয়ে শিশু মুহাম্মাদ -এর আবেগী প্রয়ােজনগুলাে পূরণ হয়েছে। শিশুদের জন্য এমন আনন্দ-উত্তেজনাময় পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা জীবনের জরুরি দক্ষতা অর্জন করতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ক্ষেত্রে সেটা ছিল মরুপ্রান্তর । আমাদের জন্য তা হতে পারে স্কুল, দিবা সেবাকেন্দ্র, রিডিং ক্লাব, আত্মীয়স্বজনের বাসা বা শিশুকেন্দ্রিক ফিটনেস সেন্টার। মানসিক বিকাশ ছয় বছর বয়স পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর মায়ের সঙ্গে ছিলেন। মা মারা যাওয়ার পর প্রথমে দাদা আবদুল মুত্তালিব এবং পরে চাচা আবু তালিবের সাথে থাকেন। একটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য যে ধরনের আদর, ভালােবাসা ও যত্ন দরকার ছিল, তার সবই তিনি তাঁদের কাছে পেয়েছিলেন। অন্যদিকে, মরুভূমির কঠিন পরিবেশ তাঁকে দিয়েছে জীবনমুখী নাম দক্ষতা অর্জনের উৎসাহ। শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে প্রথম ছয় বছরে। প্রথম বছরে শিশুর মধ্যে অনুভতি জন্মলাভ করে। দ্বিতীয় বছর থেকে তার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকে। তৃতীয় বছরে বাচ্চারা অন্যের সাথে ভাববিনিময় করতে শেখে। চতুর্থ বছর থেকে ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে আত্মনির্ভরশীল। পঞ্চম আর ষষ্ঠ বছরে তারা নিজেদের চাওয়া-পাওয়াগুলাে তুলে ধরতে শেখে। এ সময় নিজেদের আবেগ-অনুভূতিগুলাে আরও ভালােভাবে প্রকাশ করতে শেখে। শিশুদের এই ছয় বছরের ব্যাপারগুলাে একটি চার্টে আমরা দেখব। এই অধ্যায়ে আমরা ছয় বছর বয়স পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর বাল্যকালকে দেখব। তাঁকে বড় করতে যেয়ে তার মা ও দুধ-মা কী বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন, তা দেখব। এরপর দেখব, তাঁর শিশুকালের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা কীভাবে শিশুদের বড় করতে পারি। ছয় বছরের নিচে বাচ্চারা পরিবেশ আর ব্যক্তিত্ব ভেদে শিশুদের বেড়ে ওঠার গতি কমবেশি হয়ে থাকে। সে হিসেবে বলতে গেলে রাসূলুল্লাহ তার বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বড় ছিলেন। তাঁর বয়স যখন দুবছরের নিচে, তখন তার এনার্জি দেখে অনেকেই অবাক হতেন। তারপরও শিশুদের মাঝে এমন কিছু ব্যাপার থাকে যা মােটামুটি সবার জন্য এক। ছয় বছর পর্যন্ত একজন শিশুর বেড়ে ওঠার ব্যপারগুলেো আমরা আর একটা চার্টে দেখব। শিশুরা সাধারণত প্রথম পর্যায়গুলাে মায়ের সাথে বেশি কাটায়। অনুভূতি সংক্রান্ত চাহিদাগুলাে তিনিই পূরণ করেন। আর পরবর্তী পর্যায়গুলাে সামাজিক আর ভাষাগত দক্ষতা অর্জনে কেটে যায়। আমরা দেখি যে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর জীবনেও এমনটা হয়েছে। অন্য আর দশটা শিশুর মতাে তার ঐ সময়টাও কেটেছে একান্তে মায়ের সাথে। ভালােবাসার চাহিদা পূরণ বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের আর্থিক দায়দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন দাদা আবদুল মুত্তালিব। সংসার খরচের চিন্তা না-থাকায় মা আমিনা তার পুরাে সময়টা ছেলের পেছনে দিতে পেরেছিলেন। মা হিসেবে বাবা না থাকার কষ্ট কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিতে পেরেছিলেন। কখনাে আদরঘন আলিঙ্গন, কখনাে মমতামাখা চুমু, কখনাে-বা শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দিকে তাকিয়ে ভালােবাসার হাসি, এভাবেই তাকে আগলে রেখেছিলেন মা আমিনা। শিশুকালে রাসূল (সাঃ)তার মায়ের সঙ্গে খুব বেশি একটা সময় কাটাতে পারেননি। অনেক শিশুরা এ বয়সে মায়ের সাথে অনেক সময় কাটায়। কিন্তু তারপরও শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) যে ভালােবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন, সেটা আজকাল অনেক শিশুর ভাগ্যেই জোটে না। আজকালকার মায়েরা অনেক বেশি ব্যস্ত। অনেক দায়িত্ব; ঘর সামলানাে, চাকরি, স্বামীসেবা, অন্যান্য বাচ্চাদের দেখভাল ইত্যাদি। মা আমিনার কাধে এত বােঝা ছিল না। সংসার খরচের দায়ভার নিয়েছিলেন দাদা। কুঁড়ি বছর বয়সেই বিধবা আমিনাকে এসব নিয়ে কোনাে দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। আমিনার সব ব্যস্ততা ছিল একমাত্র সন্তান মুহাম্মাদকে ঘিরে। তখনকার সমাজে সন্তানের বেড়ে ওঠায় বাবারাই মূল ভূমিকা পালন করতেন। কিন্তু পরিস্থিতির দাবি মেনে মা আমিনা তার মাতৃসুলভ ভালােবাসা আর আদরের পুরােটাই একমাত্র সন্তান মুহাম্মাদ -এর ওপর ঢেলে দিয়েছিলেন। সন্তানের ওপর ভালােবাসার প্রভাব শিশুর মানসিক বিকাশে ভালােবাসা আর আদরের প্রভাব অনেক। এতে তার নিজের ব্যাপারে আস্থা জাগে, আত্মবিশ্বাস জন্মে। আবেগ-অনুভূতি গড়ে ওঠে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, এতে করে শিশুরা নিজেদের নিরাপদ মনে করে। পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা বাড়ে। আপনিও আপনার বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরুন। ঘুম থেকে ওঠার পর কিংবা বাইরে থেকে বাসায় এসে তাকে সালাম দিন। চুমু দিন। তার সাথে খেলুন। এগুলাে ওর মানসিক স্বাস্থ্য ভালাে রাখবে। আত্মমর্যাদা বাড়াবে। আপনার অবস্থা হয়তাে এমন না যে, আপনি পারফেক্ট বাবা-মা হবেন। কিন্তু যতটুকু পারুন ওকে সময় দিন, আদর করুন। মনােযােগ দিন। মাঝেমধ্যে বা কেবল বিশেষ কোনাে ঘটনায় ওর প্রতি আদর না-দেখিয়ে নিয়মিত দেখান। কীভাবে শিশুর মানসিক চাহিদা পূরণ করবেন • প্রতিদিন চুমু দিন, জড়িয়ে ধরুন। • ওর কথা মন দিয়ে শুনুন। বাধা দেবেন না। • বাসার বাইরে থাকলে ফোন দিয়ে কথা বলুন। • ওর সাথে খেলুন। •নিজের পোশাক ময়লা হওয়া নিয়ে চিন্তার দরকার নেই। • ভালোবাসা দিয়ে দিন শুরু করুন। আর অখুশিহয়ে কখনো দিন শেষ করবেন না। সন্তানের জন্য বাঁচা মা আমিনার স্বামী মারা যান ৫৭১ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র বিশ । তারপরও তিনি কিন্তু আর বিয়ে করেননি। তখনকার সমাজ অবশ্য বিধবাদের খাটো চোখে দেখত না। যাদের বংশ ভালাে ছিল, তাদেরকে উঁচু নজরে দেখত। আমিনার রূপ আর কবিতা আবৃত্তির গুণে চাইলেই তিনি আবার বিয়ের পিড়িতে বসতে পারতেন। সমাজ যে তাঁকে এ ব্যাপারে। পীড়াপীড়ি করেনি, তা কী করে বলি? কিন্তু তিনি বিধবাই থেকে গেলেন। সেই সমাজে বড় পরিবারের আলাদা মর্যাদা ছিল। আমিনার মনেও হয়তাে অমন বড় পরিবারের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তিনি হয়তাে তার ছেলে মুহাম্মাদের জন্য নিজেকে কোরবান করেছিলেন। শিশু মুহাম্মাদের জীবনকে ফুলে-ফলে সুশােভিত করতে নিজের জীবনের সাথে আপােষ করেছিলেন। তার এই সিদ্ধান্ত মােটেও স্বাভাবিক ছিল না। ছিল প্রথাবিরােধী। বিশ বছর বয়সী এক বিধবা তরুণীর জন্য এই সিদ্ধান্ত যে অনেক কষ্টের ছিল, তা বলাই বাহুল্য। কীভাবে নিজের সন্তানকে অগ্রাধিকার দেবেন শিক্ষাবিদরা শিশুদের জন্য আলাদা সময় রাখার গুরুত্বের কথা বলেন। যেন মনে হয়, শিশুদের সাথে সময় কাটানাে একটা বােঝা। আনন্দের কিছু না। চাকরিজীবী মায়েরা তাদের সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। এতে অনেক মা-ই মনে মনে এক ধরনের অপরাধবােধে ভােগেন। তাদের এই অপরাধবােধে প্রলেপ দেয়ার জন্য আলাদা সময় ধারণার জন্ম হয়। অথচ আলাদা সময়ের বদলে আমাদের তাে শিশুদের সাথে এমনিতেই সময় কাটানাের কথা। আর সেটাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ঘড়ি ধরে কেন? কত সুন্দরভাবে সময় কাটাচ্ছি বিবেচনার সাথে সাথে কতক্ষণ সময় কাটাচ্ছি, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ না। বাবা-মায়েরা সন্তানের সাথে যত বেশি সময় কাটাবে (এখানে ‘বেশি’ বলতে পরিমাণের কথা বলছি) তাদের সামাজিক, মানসিক ও একাডেমিক সমস্যা তত কম হবে। মাদকে জড়ানাের আশঙ্কা কমবে। বখাটেগিরি বা এ ধরনের কোনাে অপরাধমূলক কাজ অথবা বিয়ের আগে বিপরীত লিঙ্গের কারও সাথে হারাম সম্পর্কে জড়ানাের প্রবণতা কমবে। লরা রামিরেজের কথায় এমনটাই পাওয়া যায়। বাচ্চাদের পার্কে নিয়ে যান। এটা ভালাে। কিন্তু এটা কোনােভাবেই ভালাে প্যারেন্টিং-এর বিকল্প নয়। বাবা-মা'কে তাদের বাচ্চার ছায়া হয়ে থাকতে হবে। এর মানে তাদের সাথে। ভালাে সময় কাটাতে হবে। ওদের সময়টা যখন ভালাে যাবে না, তখন ওদের পাশে থাকতে হবে। ওদের প্রতিটা সমস্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। বাচ্চার সাথে সময় কাটানাের মানে কী • সময় কাটানাে মানে এই না যে, সব সময় কিছু না কিছু করতেই হবে। ওদের সাথে থেকে ওরা কী করছে, না করছে তার ওপর নজর রাখাই যথেষ্ট। •ওকে সময় দেয়া সংসারের দৈনন্দিন টুকিটাকি কাজের অংশ নয়। কাজেই ওকে এমনভাবে সময় দেবেন না, যাতে ওর মনে এইধারণা উঁকি দেয়। • যেকোনো সময় আপনার কাছে ঘেষতে ওর মনে যেন কোনাে ধরনের সংকোচ কাজ না করে। মরু শিক্ষা রাসূল ছালেবেলায় শুধু মায়ের কাছ থেকেই শেখেননি। তার দুধ-মা হালিমা এবং তার পরিবার থেকেও মানসিক বিকাশের শিক্ষা নিয়েছেন। হালিমার আরও তিন সন্তান ছিল- আবদুল্লাহ, আনিসা, শায়মা। সাথে ছিল তার স্বামী আল হারিস। মক্কা থেকে তাদের বাড়ির দূরত্ব ছিল ১৫০ কিলােমিটার। মাঝে মাঝেই এখান থেকে মক্কায় যাওয়া হতাে তার। প্রায় চার বছর তিনি এখানে কাটিয়েছেন। অনেক কিছু শিখেছেন এখান থেকে। সে সময়কার আরব উপদ্বীপের মরুভূমি অঞ্চল সম্পর্কে জানলে সহজে বুঝতে পারব রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাল্যকালে মরুভূমির ভূমিকা কেমন ছিল। কী কী মূল্যবােধ তিনি এখান থেকে শিখেছেন। তখন স্কুল-কলেজ বলতে তেমন কিছুই ছিল না। মরুভূমির এক একটা পরিবারই ছিল এক ধরনের স্কুল। শহরের মা-বাবারা বাচ্চাদের চারিত্রিক বিকাশের জন্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যই মরুর এসব পরিবারে পাঠাতেন। মূলত, গ্রামাঞ্চল ও মরুভূমির চেয়ে শহর অঞ্চলে অসুখ-বিসুখের মাত্রা ছিল তুলনামূলক বেশি। শহরের জনসংখ্যা ছিল প্রায় বিশ হাজার। ইসলামের বার্তা পুনরায় চালু হওয়ার আগে থেকেই সেখানে হজের রীতি বহাল ছিল। হজ্বের সময়ে স্বাভাবিক কারণে লােকজনের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেত। যার কারণে নানা রকম রােগ বালাই এর আশঙ্কাও বৃদ্ধি পেত। এসব কারণে রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা বাড়ানাের জন্য সেসময় অধিকাংশ শহুরে পরিবারের বাচ্চাদের মরু অঞ্চলে পাঠানাে হতাে। তাছাড়াও মরু অঞ্চলের কথ্য আরবি যেকোনাে ধরনের বিকৃতি থেকে মুক্ত ছিল। মরুভূমির বেশিরভাগ নারীই পেশা হিসেবে বা পারিবারিক বন্ধন গড়ার খাতিরে শহরের বাচ্চাদের লালন-পালনের জন্য নিয়ে যেতাে। নতুন আর অজানাকে জানার, আবিষ্কারের পসরায় সজ্জিত ছিল মরুভূমির উন্মুক্ত বালুচর। শহরের দালানঘরে সেই সুযােগ কোথায়? মরুভূমিতে থেকে থেকে শিশু মুহাম্মাদের সামাজিক আর যােগাযােগের দক্ষতা বেড়েছে। শারীরিক সামর্থ্য বেড়েছে। ভাষা শাণিত হয়েছে। সে সময়ের মরুঅঞ্চল, বাচ্চাদের এসব দিকগুলাে বিকাশের জন্য দারুণ সহায়ক ছিল। তবে আজকের জমানায় এসে আমি আপনার শিশুকে মরুভূমিতে পাঠাতে বলব। কিন্তু যেসব পরিবেশ শিশুদেরকে উদ্দীপ্ত করবে, সেগুলােকে কখনােই উপেক্ষা করবেন না। এগুলাে হতে পারে স্কুল, দিবাসেবা, আত্মীয়ের বাসা কিংবা এ ধরনের অন্য কিছু। খেয়াল রাখতে হবে, এই জায়গাগুলাে যেন। নিরাপদ হয় এবং শিশুর প্রতিভা বিকাশ ও আবিষ্কারে সহায়ক হয়। মরুজীবন মরুজীবনের বাস্তবতা বুঝার দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে। যথা:- • মুহাম্মাদ -এর জীবনে মরু জীবন কী ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। • তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে আমরা কী শিখতে পারি। মরুবাসীদের জীবন ছিল যেনতেন উপায়ে বেঁচে থাকা। টিকে থাকাটাই মূখ্য। বিলাসিতার কোনাে জায়গা নেই সেখানে। শুষ্ক এই আবহাওয়ার তীব্র দাবদাহে সূর্যের নিচে ডিম ভাজি হয়ে যেত। পানি আর ছায়া দুটোরই অভাব ছিল। আজকাল আমরা পিপাসা মেটানাের জন্য যে পরিমাণ পানি খাই, তখন তারা এত খাওয়ার সুযােগ পেত না। সামান্য পানি খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য শুধু গলা ভেজাতেন। যেহেতু পানি কম ছিল, খাবারের উৎসও কম ছিল। মরুদ্যান, কুয়াে বা ঝরনার আশপাশ ছাড়া ফসলের ক্ষেত খুব একটা হতাে না। খাওয়ার কষ্ট, পানির কষ্ট নিয়েই বেদুইনরা বাঁচতে শিখেছে। আরও খাবাে, আরও খাবাে! এ রকমটা বলে অভিযােগ করতেন না। খাওয়া-দাওয়া। বা ভােগ করা তখন আনন্দের জন্য ছিল না। ছিল টিকে থাকার জন্য। জীবনের এই কঠিনতা তাদেরকে জীবনের দুঃখ কষ্ট গুলােকে বিনা অভিযােগে বরণ করতে শিখিয়েছিল। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এ ধরনের পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর ওপর এই পরিবেশের যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তিনি কখনাে পেট পুরে খাননি। ক্ষুধার যন্ত্রণা দমন করার জন্য পেটে চ্যাপ্টা পাথর বাঁধতেন। এমন কত দিন গেছে তার ঘরে চুলাে জ্বলেনি। খুব কম সময়েই তিনি মাংস খেয়েছেন; বরং বেশিরভাগ সময়েই খসখসে রুটি খেতে হয়েছে। খাবার না থাকলে সিয়াম পালন করতেন। তালগাছের পাতা দিয়ে বানানাে মাদুরে ঘুমােতেন। বর্তমান দুনিয়ার চোখে দেখলে তার জীবনযাপন পদ্ধতি অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে তিনি বাচ্চা বয়সেই এমনটা শিখেছেন। সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে ধরে রেখেছেন। এমনকি মক্কায় আসার পরও। মরুভূমিতে তিনি যেসব দামি মূল্যবােধ অর্জন করেছিলেন, তার নিজ পরিবেশ সেগুলােকে আরও জোরদার করেছে। মরুভূমি থেকে নিয়ে আসা মূল্যবােধ রাসূল (সাঃ)মরুজীবন থেকে যে শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন, তাঁর মা সেটার মূল্য বুঝেছিলেন। স্কুলে যদি ভালাে কিছু শেখায়, তাহলে বাবা-মায়েদের বিরােধী কিছু শেখানাে ঠিক হবে না। শিশুকে বরং এমন পরিবেশ দিতে হবে, যেটা তার স্কুলের শিক্ষাকে আরও পােক্ত করবে। মরুস্কুলে রাসূল (সাঃ)ও সহ্য করার ক্ষমতা আর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের যে শিক্ষা নিয়েছিলেন, মা আমিনা তার ঘরে সেই একই শিক্ষা জারি রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)ও মরু শিক্ষার বাস্তবতা পরিবারে এসেও পেয়েছিলেন। পারিবারিকভাবেই তার জীবন ছিল সাদাসিধা, অনাড়ম্বর। তাঁর মা শুকনাে মাংস খেতেন। দাদা দানের টাকা জোগাড় করে হজ্ব পালনকারীদের পানির ব্যবস্থা করতেন। চাচা যৌথ পরিবারের খরচ জোগাতেন। ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ পরিবারেই পেয়েছিলেন। বাচ্চাকাচ্চারা স্কুলে যা শেখে, ঘরে এবং সাধারণভাবে সমাজে যদি সেই একই শিক্ষা জোরদার করে, তাহলে বাচ্চারা নিজেদের নিরাপদভাবে এবং আত্মবিশ্বাসী হয়। আত্মশৃঙ্খলার মূল্য শৃঙ্খলার মাধ্যমে শিশুরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। তাদের আচারআচরণ সন্তোষজনক হয়। ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শেখে। তবে এজন্য বাবামায়ের তরফ থেকে এনার্জি ও কমিটমেন্টের দরকার হয়। বাবা-মা কতটা শক্তি ঢালবেন আর কতটা লেগে থাকবে তা নির্ভর করে বাচ্চার ব্যক্তিত্ব এবং কী রকম পরিবেশে সে বেড়ে উঠছে তার ওপর। রাসূল (সাঃ) মরুভূমিতে শৃঙ্খলার পাঠ নিয়েছেন। নির্দিষ্ট সময়ে তাঁকে ঘুমােতে যেতে হয়েছে। উঠতে হয়েছে। বিভিন্ন কাজেকর্মে সহযােগিতা করতে হয়েছে। গবাদিপশুর দেখভাল করতে হয়েছে। একটু অন্যরকমভাবে মক্কায় নিজের বাড়িতে সেই একই শৃঙ্খলা জোরদার করা হয়েছে। বাচ্চার চারপাশ আর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে খাপ খায় এমন শৃঙ্খলার মধ্যে বাচ্চাকে বেড়ে তােলা আজকের দিনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ । মন যা-ই চাক, বাচ্চাকে দায়িত্ববানের মতাে কাজ করতে হবে এটাই শৃঙ্খলা। কচি বয়সেই এটা গড়ে তুলতে হবে। ষাটের দশকের শেষের দিকে বাচ্চাদের শৃঙ্খলা নিয়ে এক বিখ্যাত গবেষণা হয়। সেখান থেকে দেখা যায়, বাচ্চা বয়সে শেখা শৃঙ্খলা পরবর্তী বয়সে টেকসই হয়। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ওয়াল্টার মিসচেল চার বছর বয়সী একদল বাচ্চাকে একটা করে মার্শম্যালাে দেন। তাদেরকে দুটো অপশন দেন; হয় এখন খাও। নয় পরে খাও। তবে পরে খেলে আরেকটা মার্শম্যালাে পাবে। তাে এই গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশুরা তাদের খাওয়ার লােভ সংবরণ করতে পেরেছিল, পরিণত বয়সে তাদের মধ্যে শৃঙ্খলার ছাপ বেশি পাওয়া গিয়েছিল। জীবনে তাদের অর্জনও বেশি। বাচ্চাকাচ্চাদের শৃঙ্খলা শেখাবেন কীভাবে মারধর, গালি-বকা দিয়ে শৃঙ্খলা শেখানাে যায় না। সদয় আচরণ আর সুন্দর লালন-পালনের মাধ্যমে এটা সম্ভব। নিচে আমরা কিছু উপায় দিচ্ছি। চেষ্টা করে দেখুন • ভালাে কাজের প্রশংসা করুন। এটা তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস |
No comments